মার্চ ০৭, ২০২৩ ২১:৫১ Asia/Dhaka
  • রূপকথার গল্প: আশা পূরণের গাছ

রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো ও সুস্থ আছো। আজকের আসরে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশিদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, আজকের আসরের শুরুতেই থাকছে একটি রূপকথার গল্প। গল্পের পর থাকবে একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক।

সে অনেক দিন আগের কথা। চীনের একটি শহরে একটি গাছ ছিল। ঐ গাছটিকে 'পূজনীয় গাছ' বা 'উদ্দেশ্য পূরণের গাছ' হিসেবে অভিহিত করা হতো। শহরের লোকেরা ছিল মূর্তিপূজারি। ঐ গাছটিকে তারা দেবতার মতো পূজা করত। প্রতি সপ্তাহে একদিন সবাই সেখানে জড়ো হতো এবং মন্ত্রাদি পাঠ করত। আর যাদের কোনো সমস্যা থাকতো তারা ওখানে মানত করতো। টাকা-পয়সা, সোনাদানা, হীরা-জহরত ঐ মোটা গাছের একটি ছিদ্রে দান করতো। তারা বিশ্বাস করতো যে, ঐ গাছ তাদের প্রয়োজন ও উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবে।

পৃথিবী ভ্রমণকারী একজন পর্যটক একদিন ঐ শহরে গিয়ে দেখতে পেল যে, প্রচুর লোক একটি দরজা দিয়ে বের হচ্ছে। পর্যটক একজনকে জিজ্ঞেস করলেন: 'আজকে এমন কী আছে যে সবাই শহর জনশূন্য করে মরুভূমির নিকে যাচ্ছে?

লোকটি জবাব দিল : 'এটা তো কোনো নতুন খবর নয়; আজকে তো উদ্দেশ্য পূরণের গাছ উৎসবের দিন। আপনি উদ্দেশ্য পূরণের গাছটি চেনেন না?

পর্যটক বললেন: না, আমি মুসাফির মানুষ। এই মাত্রই এই শহরে প্রবেশ করেছি। আমি কখনো উদ্দেশ্য পূরণের গাছ দেখিনি।

লোকটি বলল : 'বেশ তো, আপনিও আমাদের সাথে আসুন। যদি আপনার কোনো ইচ্ছা থাকে তা হলে ঐ গাছের কাছে গিয়ে বলবেন।

একথা শোনার পর পর্যটক আর কোনো কথা না বাড়িয়ে একদল লোকের সাথে পথ চলতে আরম্ভ করলেন। শহরের দরজার বাইরে এসে দেখলেন বিশাল এক মাঠে এক প্রকাণ্ড বৃক্ষ। দলে দলে লোক বিভিন্ন মন্ত্র পড়ছে, বৃক্ষকে প্রদক্ষিণ করছে। কেউ গাছে চুমু দিচ্ছে, পূজা করছে এবং নিজের মনোবাসনা পূর্ণতার জন্য প্রার্থনা করছে। পর্যটক এ অবস্থা দেখে খুবই অবাক হলেন এবং একজন বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন : "আপনারা এ কেমন ধর্ম পালন করছেন?

বৃদ্ধ লোকটি রাগান্বিত দৃষ্টিতে পর্যটকের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল: "আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না আমরা উদ্দেশ্য পূরণের গাছের পূজা করছি? আপনি কি ধর্মে বিশ্বাস করেন না যে, এ ধরনের কথা বলছেন?"

পর্যটক বললেন: "কেন নয়? আমার ধর্মবিশ্বাস আছে কিন্তু আমি এখানে ভিনদেশী পর্যটক। আমি আপনাদের শহরের বা আপনাদের ধর্মের নই। যদি সম্ভব হয় আমাকে আপনাদের ধর্মীয় নেতার কাছে নিয়ে চলুন, তার কাছে কিছু প্রশ্ন করে কিছুবিষয় জানতে ও বুঝতে পারব।"

বৃদ্ধ লোকটি বলল: চলুন. আপনাকে আমাদের সবচেয়ে বড় ধর্মগুরুর কাছে নিয়ে যাচ্ছি। তিনি আপনাকে সবকিছু বলতে পারবেন।

লোকটি ময়দানের কোনায় একটি তাঁবুর কাছে নিয়ে পর্যটককে গেলেন এবং শহরের সবচেয়ে বড় ধর্মগুরুর কাছে নিয়ে গিয়ে দেখা করার অনুমতি চাইলেন। পর্যটক নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন: "আমি দুনিয়ার অনেক দেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। কিন্তু আপনার শহরের মতো এমন আজব জিনিস এবং এ রকম উদ্দেশ্য পূরণের গাছ কোথাও দেখিনি। আমি জানতে চাই আপনারা এই গাছটির পূজা করছেন কেন"?

বৃদ্ধ ধর্মগুরু জবাব দিলেন: "আমরা এর পূজা করি এ জন্য যে, এ গাছটি মানুষের প্রয়োজন পূরণ করে। তাছাড়া এ গাছের ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে, কথা বলে এবং অনেক বড় বড় কাজ আঞ্জাম দেয়, যা অন্য কেউ করতে পারবে না।"

ধর্মগুরুর কথাগুলো পর্যটক মেনে নিতে পারছিলেন না। তবে তা বুঝতেও দিলেন না। তিনি বললেন: আমি কি গাছটি দেখতে পারি?

বৃদ্ধ ধর্মগুরু বললেন: 'কেন নয়?

পর্যটক বললেন: 'বেশ তো, চলুন তাহলে গাছের সাথে কিছু কথাবার্তা বলা যাক।'

বৃদ্ধ ধর্মগুরু পর্যটককে নিয়ে ওই গাছের কাছে গেলেন। যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে গাছকে বললেন: 'হে পবিত্র বৃক্ষ! এই লোকটি একজন ভিনদেশী মুসাফির। তিনি আপনার সাথে কথা বলতে চান।"

গাছের ভেতর থেকে আওয়াজ এলো: "আমি ভিনদেশী লোকদের কদর করি। কিন্তু যদি সে বিশ্বাস স্থাপন না করে এবং আমাদের ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়, তাহলে তার সাথে কথা বলব না।"

পর্যটক ধর্মগুরুকে বললেন: "এত সহজে কোনো কিছুর উপর বিশ্বাস স্থাপন করব না আমি। এ গাছকে পরীক্ষা করবো। কিছু জ্বালানি তেল নিয়ে এসে গাছটিতে আগুন ধরিয়ে দেবো। যদি দেখি গাছ আগুনে না জলে তাহলে মেনে নেবো অথবা করাত এনে কাটার চেষ্টা করবো। যদি না কাটে তবে বিশ্বাস স্থাপন করব।"

ধর্মগুরু বললেন : "এমন পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। যদি লোকেরা বুঝতে পারে যে, আপনার মনে এমন বাজে ধারণা পোষণ করেন তাহলে আপনাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।"

পর্যটক বললেন : "ঠিক আছে, আমি বিশ্বাস স্থাপন করব না। আর এ গাছের মাধ্যমে আপনাদের কল্যাণ হবে এমন কোনো বিশ্বাস আমি করি না। আপনাদের সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই। আপনাদের শহরে কয়েক দিন ঘুরে বেড়াবো। এরপর চলে যাবো।'

পর্যটক বুঝতে পেরেছিলেন যে, উদ্দেশ্য পূরণের গাছে একটা কিছু রহস্য আছে। এখানে একটা ধোঁকাবাজি চলছে, কিন্তু মানুষ ভয়ে কিছু বলতে পারছে না। ঐদিন শহরের লোকেরা তাদের বাসগৃহে ফিরে গেলে পর্যটক চিন্তা করলেন: এইতো মোক্ষম সুযোগ। রাতে যাব ঐ বৃক্ষের কাছে। কুড়াল দিয়ে গাছটাকে কাটাব এবং এর রহস্য উদ্ঘাটন করব। লোকেরা যে অজ্ঞতার ঘোরের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে সেখান থেকে তাদেরকে মুক্ত করব।

পর্যটক মধ্যরাতে করাত ও কুঠার নিয়ে গাছের কাছে গেলেন। গাছে করাত চালানোর পর শব্দ শুনেই বুঝলেন যে, গাছের মধ্যে ফাঁপা জায়গা আছে। এ সময় গাছের মধ্য থেকে আওয়াজ করে কেউ বলল: "এই তুমি কে? কী করতে চাও? করাত এনেছো কেন?

পর্যটক বললেন: "শুধু করাত না, কুঠারও আছে; তোমাকে কাটতে চাই আর এই রহস্যের মূলোৎপাটন করতে চাই।"

গাছের মধ্য থেকে আওয়াজ এলো: "আমার মধ্যে এমন কী খারাপ দেখলে যে, আমার সাথে শত্রুতা আরম্ভ করলে?"

পর্যটক বললেন: "খারাপ কিছু করোনি। কিন্তু তুমি সাধারণ লোকদের ধোঁকা দিচ্ছো এবং খোদার স্মরণ থেকে অমনোযোগী করে তুলছো। আর আমি জানি তোমার মধ্যে একটা রহস্য, একটা ধোঁকাবাজি আছে। আমি মানুষকে ধোঁকা থেকে বিরত রাখতে চাই।"

গাছের ভেতর থেকে একজন বলল: "তুমি ভুল করছো। আমি মানুষের পূজনীয় গাছ। আর লোকেরা আমার দ্বারা উপকৃত হয়। যদি তোমার কোনো প্রয়োজন থাকে তা হলে বলো আমি সমাধান করবো। যদি তুমি এখান থেকে চলে যাও তাহলে প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সময় এক পেয়ালা স্বর্ণ তোমাকে দেবো যাতে খুব দ্রুত সম্পদশালী হতে পারবে। তুমি রাজি কিনা বলো?

একথা শুনে পর্যটক তাজ্জব বনে গেলেন। বললেন: 'তুমি কিভাবে   স্বর্ণ দেবে?'

গাছ বলল: প্রতিদিন সকালে সূর্যোদয়ের পূর্বে শহরের দরজা থেকে বেরিয়ে এসে তোমার ডান পাশে একটি হ্রদ দেখতে পাবে। হ্রদের উপরে একটি ব্রীজ আছে। ব্রীজের দু'পাশে ছোট দেয়াল আছে যাতে জানালা আছে। এর ডান পাশের প্রথম জানালার উপরের চতুর্থ সেলফে এক বাটি স্বর্ণ দেখতে পাবে। যা তুলে নিয়ে নিরাপদে বাড়ি যাবে।

পর্যটক বিস্মিত হলেন। তিনি তাঁর কুঠার ও করাত নিয়ে চলে গেলেন। পরের দিন নির্দেশিত পথে গিয়ে এক বাটি স্বর্ণ দেখতে পেয়ে নিয়ে আসলেন। পরের দিনও একইভাবে স্বর্ণ পেলেন এবং চিন্তা করলেন- এটা তো খারাপ না। আমার অর্থ উপার্জন হচ্ছে। উদ্দেশ্য পূরণের গাছ আমার তো কোনো ক্ষতি করছে না।

এরপর ছয় দিন কেটে গেল। কিন্তু সপ্তম দিন কোনো স্বর্ণ পেলেন না। তখন তিনি বিষণ্ণ হয়ে বললেন- এ পর্যন্ত উদ্দেশ্য পূরণের আমাকে স্বর্ণ দিয়েছে। আমিও কোনো কথা বলিনি। এখন বোঝা যাচ্ছে গাছ আমাকে ভুলে গেছে। আজ রাতে গিয়ে এ বিষয়ে কথা বলব।

মধ্যরাতে করাত ও কুঠার নিয়ে পর্যটক গাছের কাছে পৌঁছলেন। এসময় গাছের দু'পাশ থেকে দু'ব্যক্তি চিৎকার করে বলল: এই ব্যাটা দাঁড়া, একদম নড়বি না। যদি এক পাও নড়িস, তবে একবারে শেষ করে ফেলব।

পর্যটক ভয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। দু'জন বিশালকায় লোক সামনে এসে বলল: এই মধ্যরাতে এখানে কেন?

পর্যটক জানের ভয়ে বললেন: গাছের দর্শনে এসেছি।

তারা বলল: 'এটা দর্শনের সময় না; এখন ঘুমের সময়। আর তোর কাছে করাত-কুঠার কেন? জানিস না, এই গাছের কাছে করাত-কুঠার নিয়ে আসা নিষেধ।

পর্যটক নিরুপায় হয়ে করাত-কুঠার রেখে একাকী গাছের কাছে গিয়ে চিৎকার করে বললেন: 'হে উদ্দেশ্য পূরণের গাছ। আমি সেই ভিনদেশি লোক যাকে তুমি কথা দিয়েছিলে প্রতিদিন এক বাটি স্বর্ণ পাবো। কিন্তু জানালার কাছের চতুর্থ সেলফে কোনো স্বর্ণ ছিলো না।

গাছ জবাব দিল: হ্যাঁ, স্বর্ণ শেষ হয়ে গেছে। যদি 'টু' শব্দ করো আর কাউকে এ বিষয়ে কিছু বলো তাহলে শহরের লোকদের বলে দেবো যে, তুমি একটা বেদীন ও গোনাহগার; আমাকে অসম্মান করেছ। তারা তোমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।

পর্যটক বুঝলেন যে, এই গাছের কাছে জোর চলবে না। তাই কুঠার ও করাত নিয়ে সেখান থেকে ফিরে এলেন। পরের দিন ওই শহর থেকে অন্য শহরে চলে গেলেন। সেখানকার লোকেরা খোদাভীরু। পর্যটক ঐ শহরের ধর্মগুরুকে দেখতে পেলেন- যাকে সবাই 'মুরশিদ' বলে ডাকে। তার সাথে কথাবার্তার এক পর্যায়ে বললেন - উদ্দেশ্য পুরণের গাছের বিষয়টা বুঝলাম না। সে কীভাবে কথা বলে আর সব মানুষকে আকৃষ্ট করে?   

মুরশিদ বললেন: ঐ গাছটি শত শত বছর থেকে অন্যান্য গাছের মতো সাধারণ গাছের মতোই ছিল। যেহেতু গাছটি অনেক মোটা ছিল আর শহরের প্রবেশ পথেই শহরের পূর্বেকার প্রশাসক শহরের মধ্যে একটি সুড়ঙ্গ তৈরি করেন এবং ঐ গাছের মধ্য পর্যন্ত তা বিস্তৃত করেন। ঐ গাছটিতে অন্যান্য অনেক পুরোনো গাছের মতো বড় ফাপা ছিল। প্রশাসকের একজন পাহারাদার সেখানে অবস্থান করতো। যুদ্ধ শুরু হলে অন্য শহরের সৈন্যরা ঐ পথ দিয়ে প্রবেশ করতো। তাদের অবস্থান ও কথাবার্তার সংবাদ ঐ পাহারাদার প্রশাসকের কাছে নিয়ে আসতো।

মুরশিদ আরও বললেন: একদা ঐ পাহারাদার গাছের উপরের দিকে ফাঁকাতে অবস্থান করছিল। সে মজা করে গ্রামের এক লোককে বলছিল- 'আমি হলাম উদ্দেশ্য পূরণের গাছ'। গ্রামের সহজ সরল লোকটি তা বিশ্বাস করে তার মানত ও হাদিয়া গাছের ছিদ্রের ভেতরে দিল এবং কাকতালীয়ভাবে তার মনোবাসনা পূর্ণ হলো। গ্রামের ঐ লোক অন্যদের কাছে ঐ ঘটনা বলল। তারাও বিশ্বাস করে হাদিয়া দিতে আরম্ভ করল।

গাছের মধ্যে যে পাহারাদাররা অবস্থান করছিল তারা দেখলো ভালোই তো ব্যবসা হচ্ছে। তারা এভাবে টাকা-পয়সা গ্রহণ করতে লাগলো আর কথা বলতে থাকল। কিছুকাল পরে একদল ধোঁকাবাজ লোক মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য এটাকে পেশা হিসেবে নিল এবং পয়সা কামাতে থাকলো। এভাবে বছরের পর বছর ধরে ধোঁকাবাজি চলছে।

পর্যটক আর কোনো কথা বললেন না। মূর্তিপূজকদের রহস্য বুঝতে পারলেন। এরপর তিনি অন্য কোনো অজানা শহরে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

শিশু-কিশোর বন্ধুরা, অনুষ্ঠান থেকে বিদায় নেওয়ার আগে তোমাদের জন্য রয়েছে একটি গান। সূরা ফাতিহা অবলম্বনে গানটি লিখেছেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। সুর করেছেন মশিউর রহমান। আর গেয়েছে ক্লাসিক ওয়ার্ল্ড সঙ্গীত একাডেমির শিশু শিল্পীরা।

বন্ধুরা, তোমরা গানটি শুনতে থাকো আর আমরা বিদায় নিই রংধনুর আজকের আসর থেকে।# 

 পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ